নতুন বছরের শুরুতেই বাংলাদেশ সরকার সঞ্চয়পত্রের জন্য নতুন মুনাফার হার ঘোষণা করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। পূর্ণ মেয়াদে কোনও সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১২ শতাংশের কম নয়। আগে এই হার ১২ শতাংশের নীচে ছিল। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, ছয় মাস পর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার পুনরায় নির্ধারণ করা হবে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন সঞ্চয় অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা।
গত বছরের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার
গত পয়লা জানুয়ারির আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীরা আগের হারেই মুনাফা পাবেন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুদ হার বাজারভিত্তিক করা হয়। এর আগে নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এসব হার নির্ধারণ করা হত। নতুন প্রজ্ঞাপনে বিনিয়োগের জন্য দুটি পরিসীমা বা স্তরে বিভাজন করার কথা বলা হয়েছে।
সঞ্চয়পত্রের নতুন মুনাফার হার কাঠামো
প্রথম স্তর: ৭,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত
প্রজ্ঞাপনে ৭,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত প্রথম স্তর এবং ৭,৫০,০০০ টাকার ওপরে দ্বিতীয় স্তর নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম স্তরে ৭,৫০,০০০ টাকার কম বিনিয়োগকারীরা যে হারে সুদ পাবেন, এর চেয়ে বেশি অঙ্কের বিনিয়োগকারীরা মুনাফা পাবেন কিছুটা কম হারে। আগে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের জন্য অনূর্ধ্ব ১৫,০০,০১৫ থেকে ৩০,০০,০৩২ লাখের ঊর্ধ্বে এমন তিনটি ধাপ ছিল।
কর কাঠামো
এ ছাড়াও ১৫,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে সুদের উপর ৫% হারে এবং ১৫ লাখের বেশি অঙ্কের বিনিয়োগে সুদের উপর ১০% হারে উৎসে কর কেটে রাখা হয়। এই কর কাঠামো বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সঞ্চয় কর্মসূচী
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরে মোট নয়টি সঞ্চয় কর্মসূচী রয়েছে, যার মধ্যে পাঁচটি মুনাফার হার চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়কালের জন্য পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হল:
১. পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র
এই স্কিমে ৭,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে মেয়াদপূর্তিতে মুনাফার হার ১২.৪%, ৭,৫০,০০০ টাকার বেশি হলে ১২.৩%। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র প্রথম ধাপের জন্য মেয়াদ শেষে হার ১২.৩০ এবং দ্বিতীয় ধাপে ১২.২৫%।
২. পেনশনার সঞ্চয়পত্র
পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সবচেয়ে বেশি মুনাফা ধরা হয়েছে। পাঁচ বছরের মেয়াদ পার হয়ে প্রথম স্তরের জন্য ১২.৫৫% এবং দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ ৭,৫০,০০০ টাকার বেশি বিনিয়োগের জন্য এই হার ১২.৩৭%।
৩. পরিবার সঞ্চয়পত্র
বাংলাদেশে পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এই স্কিমে দুই ধাপে যথাক্রমে ১২.৫০% এবং ১২.৩৭% সুদের হার ধার্য করা হয়েছে।
আরো পড়ুন: রেসপন্সিভ ওয়েবসাইট এবং ফ্রেমওয়ার্ক
৪. ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক, মেয়াদী হিসাব
তিন বছর মেয়াদি স্কিমের ক্ষেত্রে ১২.৩০% এবং ১২.২৫% সুদ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রবাসীদের জন্য থাকা তিনটি স্কিম এবং ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক সাধারণ হিসাব সহ চারটি স্কিম অপরিবর্তিত থাকার কথা জানানো হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
সঞ্চয়পত্রের জনপ্রিয়তা ও বিনিয়োগকারীদের সুবিধা

বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে সঞ্চয়পত্র কেনা বিনিয়োগের একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। নিয়মিত ও ঝুঁকিহীন আয়ের ব্যবস্থা হয়। এতে লাখ লাখ পরিবার আছে যারা সঞ্চয়পত্র থেকে অর্জিত মুনাফা দিয়ে তাঁদের পারিবারিক ব্যয় চালান। তবে বিগত বছরগুলোয় সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে সরকার নানা ধরনের নিয়মকানুন আরোপ করে।
২০২১ সালে সুদের হার কমে যাওয়া
২০২১ সালে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দিলে অনেকেই এতে বিনিয়োগে আগ্রহ হারান। এর ফলে মানুষ সঞ্চয়পত্রের বদলে শেয়ার বাজার বা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করবে। ২০২২ সালে এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এ সবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক চাপ। ফলে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল।
অর্থনীতিবিদদের মতামত
বিবিসি বাংলাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, সুদের হার কমে যাওয়ায় লোকজন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। জনসাধারণ সঞ্চয়পত্রের প্রতিই আকৃষ্ট হত না। এই সময়ে অনেকে ব্যাঙ্ক বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকেছেন। মোদী বলেন, মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য সুদের হার কম্পিটিটিভ বা প্রতিযোগিতামূলক করা হয়েছে বলে মনে করি। নেট বিক্রি বেশি হলে সরকারের হাতে টাকা আসবে। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখনও বহাল। সাংসারিক ব্যয় নৈমিত্তিক প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে পূর্ণ মেয়াদের আগেই সঞ্চয়পত্রের অর্থ তুলে ফেলা মানুষও কম নয়।
মূল্যস্ফীতি ও সঞ্চয়পত্রের ভবিষ্যৎ
অর্থনীতিবিদদের মতে, সহসা মূল্যস্ফীতি কমার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সামনে রমজান তাই মূল্যস্ফীতি বরং আরও উঁচু হতে পারে। এমন অবস্থায় সুদের হার বাড়ালেই বিক্রয় এবং সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়বে কি না, এটি একটি প্রশ্ন। তিনি এ বিষয়ে সঞ্চয় অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে জানান, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে মানুষের জন্য আকর্ষণীয় করতে এই সুদহার বাজার ভিত্তিক করার উদ্যোগটি তাঁর বাস্তবায়ন করছেন।
সরকারের উদ্দেশ্য
অবশ্য অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী মনে করেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ বাড়িয়ে রাজস্ব ঘাটতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, মুনাফার হার বাড়ানো সঞ্চয়পত্রের ওপর যাদের পারিবারিক বা নির্ভরশীল, তারা উপকৃত হবেন। এখন সঞ্চয়পত্র থেকে যে আয় হয়, সেটা কিছুটা হলেও বাড়বে। ফলে তাঁদের হাতে কিছু বাড়তি অর্থ আসবে, যা দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার কিংবা সন্তানের পড়ালেখা ব্যবহারের মতো বিষয়গুলোতে কিছুটা সুবিধা তাঁরা পাবেন।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি
তিনি আরও বলেন, কিন্তু অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি পরিবর্তন না হয়, তা হলে সামগ্রিক অর্থনীতি খুব একটা উপকার পেতে হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদের মতে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে, কিন্তু সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এর সুফল সীমিতই থাকবে।
গুরুত্বপূর্ণ লিংক সমূহ
জাতীয় সঞ্চয় স্কিমসমূহের মুনাফার হার পুনঃনির্ধারণ PDF:
২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেট প্রাক্বলন এবং ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের প্রক্ষেপন চূড়ান্তকরণের সভার নোটিশ PDF
উপসংহার
সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে। তবে সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এর সুফল সীমিতই থাকবে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বৃদ্ধি এবং বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণের মাধ্যমে সরকার বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। তবে মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক চাপের কারণে এর প্রভাব কতটা ইতিবাচক হবে, তা সময়ই বলে দেবে।